🌍 ভূমিকা
হরমুজ
প্রণালি—পৃথিবীর অন্যতম কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক জলপথ, যা পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। এটি এমন একটি অঞ্চল যা দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ পরিবাহিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের মার্কিন-ইরান উত্তেজনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণালিটি বন্ধের প্রস্তাব বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই সংকটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এমনকি চীনের মধ্যস্থতা কামনা করেছে, যা বৈশ্বিক কূটনীতির এক বিরল ঘটনা।
📍 হরমুজ প্রণালির ভৌগোলিক পরিচিতি
হরমুজ
প্রণালি ইরান ও ওমানের মধ্যবর্তী ৪০ কিমি প্রশস্ত একটি সংকীর্ণ জলপথ। এর উত্তর সীমান্তে ইরান এবং দক্ষিণে ওমানের মুসান্দাম প্রদেশ। এই প্রণালি দিয়ে দৈনিক গড়ে ২০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২০%।
🛢️ কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
✅
তেলের লাইফলাইন
- সমুদ্রপথে পরিবাহিত তেলের এক-তৃতীয়াংশ এই প্রণালি দিয়েই যায়।
- সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই পথের মাধ্যমে তেল রপ্তানি করে।
- ২০২২ সালে এখান দিয়ে পরিবাহিত তেলের ৮২% গিয়েছিল চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার দেশগুলোতে।
✅
গ্যাস ও পণ্য পরিবহন
বিশ্বের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। বার্ষিক প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলারের জ্বালানি বাণিজ্য এই পথ দিয়ে সম্পন্ন হয়।
⚠️
সাম্প্রতিক উত্তেজনা: ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্র
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোতে হামলা চালায় বলে জানায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এর জবাবে ইরান হুমকি দেয়, তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। ইরানের পার্লামেন্ট এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও চীনের ভূমিকায় প্রত্যাশা
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “চীন যেন ইরানকে ফোন করে। কারণ তারা নিজেরাই এই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল।”
চীন
বর্তমানে ইরানের সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা—মে মাসে ইরান যেসব তেল রপ্তানি করেছে তার মধ্যে ৫৫% গেছে চীনে।
তাই
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, চীন চাইলে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ইরানকে এই পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে পারে।
🛡️ ইরানের সামরিক সক্ষমতা
হরমুজ
প্রণালি বন্ধে ইরানের হাতে কয়েকটি কৌশল রয়েছে:
- নৌ-মাইন বসানো: যাতে ট্যাংকার চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়
- স্পিডবোট ও ক্ষেপণাস্ত্র: আইআরজিসির হাতে থাকা দ্রুতগামী বোট ও ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করতে পারে
- ড্রোন ও উপকূলভিত্তিক আক্রমণ: অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের মাধ্যমে হামলা চালানো সম্ভব
বিশেষজ্ঞের অনেকেই মনে করেন সমুদ্রে যান চলাচল ব্যাহত করার সবচেয়ে সম্ভাব্য পদ্ধতি হলো সামরিক অভিযান, ঠিক যেমনটা ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ঘটেছিল।
💣 প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ব কী দেখবে?
📈 তেলের দাম ও অর্থনীতি
- তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে
- বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে
- আমদানিনির্ভর দেশগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে
- বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি এক গভীর মন্দার দিকে ঠেলে যাবে
💣 হরমুজ প্রণালি সংকট:
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জ্বালানির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশ তার মোট তেলের
প্রায় ৯০% আমদানি করে,
যার বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য
থেকে আসে। এই আমদানির
বড় একটি অংশ হরমুজ
প্রণালি হয়ে আসে।
যদি এই প্রণালি আংশিক
বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়,
তাহলে:
·
তেল পরিবহনে বিলম্ব হবে
·
পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে
·
তেলের
আন্তর্জাতিক
দাম বাড়বে, ফলে বাংলাদেশের
জ্বালানি
আমদানিতে
ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে
·
বিদ্যুৎ
উৎপাদন খরচ বাড়বে
🔺 ফলাফল:
সরকারের সাবসিডি খরচ বেড়ে যাবে,
ডলার সংকটও গভীর হতে পারে।
🧨 ইরানের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
হরমুজ
প্রণালি বন্ধ করা মানে ইরান নিজেই তার প্রধান রপ্তানি পথ বন্ধ করে দিচ্ছে, ফলে তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে এবং চীনের মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেও বিরূপ সম্পর্ক তৈরি হবে।
🔄 বিকল্প রুট কতটা কার্যকর?
- সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হাবশান–ফুজাইরা পাইপলাইন তৈরি করেছে
- তবে এর সক্ষমতা মাত্র ৩.৫ মিলিয়ন ব্যারেল/দিন, যা হরমুজ প্রণালির প্রয়োজনীয়তার এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র
- তাই হরমুজ প্রণালির বিকল্প পথ এখনও নির্ভরযোগ্য নয়
🧭 উপসংহার: হরমুজ—বিশ্ব রাজনীতির দাবার বোর্ড
হরমুজ
প্রণালি এখন শুধু একটি সামুদ্রিক পথ নয়—এটি তেল, অর্থনীতি, কূটনীতি ও সামরিক উত্তেজনার একটি ঘনীভূত কেন্দ্র।
- ইরান তার ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে
- যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করছে
- চীন কৌশলগতভাবে মধ্যস্থতা করছে তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য
এই
সংকটের
সমাধান
সামরিক
শক্তি
নয়,
বরং
কূটনৈতিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছে। হরমুজ প্রণালি সচল থাকবে কিনা—এটি এখন শুধু একটি দেশের সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিশ্বের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
📚 সূত্রসমূহ:
- Bonikbarta.com
- Wikipedia (bn)
- Britannica.com
- BBC Bangla
- CNBC
- Fox News
No comments:
Post a Comment
Thanks for comment stay with us.